নতুন গাছবাড়ীয়া এন জে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একজন সভাপতির উত্তান (আনটোল্ড হিস্ট্রি)












মে ৩১, ২০১৭ সাল।  বিদ্যালয়ের মোট ছাত্রছাত্রী ২৩০০ এর ও বেশি যার মধ্যে শতকরা ৫৫ ভাগ রয়েছে ছাত্রী। নেই কোন স্থায়ী প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক। প্রায় ১৩০০ ছাত্রীর জন্য রয়েছে ছয়টি টয়লেট যার সবকটির দরজা ভাঙ্গা। জরাজীর্ণ দ্বিতল ও ত্রিতল  ভবনের নিচ তলার প্রতিটি ক্লাসরুমে বর্ষার পানি ডুকে জমা হতো হাটু পানি। অতিবৃষ্টিতে উপর তলার  কিছু শ্রেণীকক্ষে ছাদ বেয়ে গড়িয়ে পড়তো পানি। খোলা  অবস্থায় বৈদ্যুতিক তারের লাইন । বৃষ্টি পড়লেই বাতিল হয়ে যেত এসেম্বলি। শোনা যেতনা জাতীয় সঙ্গীত নামের শিক্ষার্থীদের সেই মধুর কণ্ঠের প্রতিধ্বনি।


বলে আসছিলাম ১৯১৮ সালে চন্দনাইশের প্রাণকেন্দ্র গাছবাড়িয়ায় স্থাপিত গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় এর কথা। ১৯৮২ সালে ফলাফল বিচারে কুমিল্লা বোর্ডে ৪র্থ হওয়া বিদ্যালয়টি ২০০৯  সালে চন্দনাইশে ২৬ টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ফলাফল বিচারে ২১তম।


০৮ জুন, ২০১৭। নির্বাচনে জয়লাভের পর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহন করলেন রিহ্যাব চট্টগ্রাম রিজন এর সভাপতি আব্দুল কৈয়ুম চৌধুরী।  অভিবাবক সদস্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন আবু তাহের চৌধুরী, আব্দুল মজিদ শাহ, রেজাউল করিম চৌধুরী, সাখাওয়াত হোসেন। মহিলা অভিবাবক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করলেন কোহিনুর আকতার ও শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করলেন মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, রণজিত কুমার দে ও মিতা বড়ুয়া।



০৮ জুন ২০১৮। দায়িত্ব গ্রহণের ১ বছর পূর্ণ হল বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির। ঘোষণা হয়েছে বিদ্যালয় সরকারি হওয়ার গেজেট। ২০১৮ সালের এস এস সি রেজাল্ট বিচারে উঠে এসেছে ৬ষ্ঠ তম অবস্থানে।  ছাত্রীদের জন্য উন্নত বাথরুম করা হয়েছে ৮টি। করা হয়েছে টাইলস সম্বলিত পৃথক পৃথক এবাদতখানা। জরাজীর্ণ দ্বিতল ও ত্রিতল  ভবনের নিচ তলার প্রতিটি রুমে ২ফিট ভরাট করে উচু করা হয়েছে যাতে বর্ষার পানি না ডুকে। প্রশাসনিক ভবনে করা হয়েছে সুসজ্জিত টাইলস। পূণনির্মাণ করা হয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা ছাদ। বিদ্যালয়ের প্রতিটি ভবনেই লেগেছে রঙের শৈল্পিকতার ছোয়া। তৈরি করা হয়েছে শহীদ মিনার, সুসজ্জিতভাবে সাজানো হয়েছে বিদ্যালয়ের মাঠ প্রাঙ্গণ। বর্ষার পানি না জমায় এসেম্বলি করতে অসুবিধা হয়না ছাত্রছাত্রীদের। অনায়েসে বহিরাগত প্রবেশ করার মত গেইটটি ভেঙ্গে করা হয়েছে নতুন গেইট । মূল ফটকে লেগে থাকে তালা। শ্রেণীকার্যক্রম চলাকালীন সময়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে প্রবেশ করতে পারেনা বহিরাগতরা। ঝাকঁজমক করে আয়োজন করা হয়েছে তিনদিন ব্যাপি শতবর্ষফুর্তি। প্রতিষ্ঠার ১০০ বছরে এসেই যেন পূর্ণ রূপ পেল গাছবাড়িয়া এন জে মাধ্যমিক বিদ্যালয়।




বিদ্যালয়ের এমন পরিবর্তনে আমরা কথা বলেছিলাম বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আব্দুল কৈয়ুম চৌধুরীর সাথে। আলোচনা করেছিলাম সভাপতি হওয়ার সময় ও সভাপতি হওয়ার পর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দিক নিয়ে। সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন মাহমুদুল হক।


২০০৯ সাল। বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রাক্তণ ছাত্রছাত্রী পরিষদের পূণর্মিলণী। আয়োজক কমিটির প্রধান ছিলেন আব্দুল কৈয়ুম চৌধুরী। দুইদিন ব্যাপি এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যালয় হতে পাস করে যাওয়া শিক্ষানুরাগী ব্যাক্তিরা। সবার আলোচনা সমালোচনায় উঠে আসে পিছিয়ে পড়া গাছবাড়িয়া স্কুলের করুণ অবস্থা।

শিক্ষানুরাগী প্রাক্তণ ছাত্রছাত্রীদের সহযোগিতায় বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ এর নির্বাচনে জয়লাভ করে  ১৮ই নভেম্বর, ২০০৯ তারিখে সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান চেীধুরী। সভাপতির সরলতা ও ব্যস্ততার সীমাবদ্ধতাকে পুজিঁ করে পরিচালনা কমিটির অন্যান্য সদস্যদের স্বার্থান্বেষী মহল তাদের আখের গুছাতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনবার নির্বাচিত এই সভাপতি মারা যাওয়ার দিনেই মিটিং ডেকে রাতারাতি সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তৎকালীন উপজেলা এল ডি পি’র সদস্য মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের হস্তক্ষেপে পরে এই কমিটি বাতিল করে দেওয়া হল।


কমিটি বাতিলের পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়লাভ করে সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন মাহবুবর রহমান চৌধুরী। কিন্তু নবনির্বাচিত সাংসদ আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম চৌধুরী এর যোগসাজেশে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক কমিটি বাতিল করে দেওয়া হল এবং ৬মাসের জন্য এড হক কমিটির দায়িত্ব পেলেন শেখ টিপু চৌধুরী।


শেখ টিপু চৌধুরীর মেয়াদ শেষে নির্বাচনে জয়লাভ করেন বর্তমান সভাপতি আব্দুল কৈয়ুম চৌধুরী। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের অভিযোগে ও সাংসদের যোগসাজেশে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক কমিটি আবারো বাতিল করে দেওয়া হল। পরবর্তীতে হাইকোর্টের অর্ডারে সভাপতির দায়িত্বে বহাল থাকেন আব্দুল কৈয়ুম চৌধুরী।


অভিযোগকারীরা হাইকোর্টে আপিল করলে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন শুনানির কারণে স্থগিত করা হয় কমিটি। উচ্চ আদালতে শুনানি থাকা অবস্থায় অবৈধভাবে ৫ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে ৬ মাসের জন্য পূণরায় এড হক কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন শেখ টিপু চৌধুরী।



মেয়াদান্তে শেখ টিপু চৌধুরী কোন নির্বাচন না দেওয়ায় ২ নভেম্বর ২০১৫ সালে ৬ মাসের জন্য পূণরায় এড হক কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন চন্দনাইশের বর্তমান পৌরসভা মেয়র মাহবুবুল আলম খোকা। কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও নির্বাচন দেননি বর্তমান পৌরসভা মেয়র মাহবুবুল আলম খোকা।


কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নতুন কমিটি না হওয়ায় বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম দেখা দেয়। বর্তমান সাংসদ আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম চৌধুরী পূণরায় শেখ টিপু চৌধুরীকে এড হক কমিটির দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করলেও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের  নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান শাহেদা ইসলাম তা নাকচ করে দেন। তার হস্তক্ষেপে ২০১৪ সালে সভাপতি আব্দুল কৈয়ুম চৌধুরী করা অভিযোগ তুলে নিলে ১২ জানুয়ারি ২০১৭ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তৎকালীন ইউ এন ও লুৎফুর রহমান।


ইউ এন ও  ২০১৭ সালের মে মাসে নির্বাচনের আয়োজন করলে নির্বাচনে জয়লাভ করে ০৮ জুন, ২০১৭ দায়িত্ব গ্রহণ করেন বর্তমান কমিটি।

দায়িত্ব গ্রহণ করেই বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেন বর্তমান কমিটির সভাপতি আব্দুল কৈয়ুম চৌধুরী। বিভিন্ন বাঁধা পেড়িয়ে পূর্ণতা দিয়েছেন  শত বছরের পুরোনো গাছবাড়িয়া এন জে মাধ্যমিক বিদ্যালয় কে।


বিদ্যালয়ের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে খরচ করেছেন প্রায় ৭৫ লক্ষ টাকা। যার সাড়ে ৩ লাখ টাকা জেলা প্রশাসন অনুদান, ২ লাখ টাকা উপজেলা পরিষদ অনুদান, প্রায় ২০ লাখ টাকা বিদ্যালয়ের ফান্ড, ২৬ লাখ টাকা ব্যাক্তিগত ফান্ড এবং বাকি টাকা বিভিন্ন শিক্ষানুরাগী ব্যাক্তির অনুদান। এছাড়াও শতবর্ষফুর্তি আয়োজনে খরচ করেছেন প্রায় ৬০ লাখ টাকা।


বিদ্যালয়ের এসব উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পন্ন করতে গিয়ে সম্মুখীন হয়েছেন বিভিন্ন ধরণের ষড়যন্ত্রের। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মহলের হুমকির মুখে পড়েছেন বর্তমান কমিটি।
এদিকে নিজেদের বিদ্যালয়কে নতুনভাবে দেখে উচ্ছাসিত ছাত্রছাত্রীরা। বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত হচ্ছে তারা। নিয়মিত শ্রেণীকার্যক্রম চলার পাশাপাশি দুর্বলদের জন্য রয়েছে স্পেশাল এক্সট্রা কেয়ার।



নাঈম ইসলাম নামের নবম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী বলেন, বর্ষাকালে আমরা ক্লাস করতে পারতাম না। এখন বিদ্যালয়ে ক্লাস করতে সমস্যা হয়না। নতুন ফ্যান লাগিয়েছে তাই গরম লাগেনা।


বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুর মোহাম্মদ বলেন, আগের চাইতে বর্তমানে পড়ালেখার মান, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, শিক্ষক শিক্ষিকাদের সুযোগ-সুবিধা সব বেড়েছে।  অদূর ভবিষ্যৎ গাছবাড়িয়া এন জে মাধ্যমিক বিদ্যালয় চন্দনাইশের শীর্ষ বিদ্যালয়ের স্থান দখল করবে এই প্রয়াস আমাদের।


আব্দুল কৈয়ুম চৌধুরী বলেন, বিদ্যালয়টিকে একটি আদর্শ বিদ্যালয়ে রুপ দেওয়ার ইচ্ছা আছে। আমি মনে করি সকল বাঁধা অতিক্রম করে আমরা সফল হয়েছি। বিদ্যালয়ের সরকারি গেজেট প্রকাশ হয়েছে এতে আমি অনেক খুশি। যতদিন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে আছি বিদ্যালয়ের জন্য কাজ করে যাব।

Comments

Popular posts from this blog

এক নজরে কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়ন

আর্জেন্টিনার_ইতিহাস (History Of Argentina)

প্রতারণার অষ্ট ধাতুর আংটি!! হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।